বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা : নন্দীগ্রামে প্রচারে গিয়ে তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে তোলপাড় পশ্চিমবাংলার রাজনীতি। আহত হওয়ার পর সংবাদ মাধ্যমের কাছে মমতা নিজেই ‘আক্রান্ত’ হওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন। জানিয়েছিলেন, ৪–৫ জন নাকি তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। তৃণমূলের অনেক নেতাই বিজেপিকে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। তবে বিজেপি–সহ প্রায় সব বিরোধী দলই মমতার বিরুদ্ধে ‘নাটক’ করার অভিযোগ তুলেছে। বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও কার্যত অভিযোগের আঙুল তোলে তৃণমূল। কিন্তু কমিশন চুপ করে বসে নেই। পাল্টা কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছে তৃণমূলকেও।
তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আহত হয়েছেন, সে কথা সত্য। কিন্তু তাঁর ‘আক্রান্ত’ হওয়ার তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, মমতা ‘জেড প্লাস’ ক্যাটাগরির নিরাপত্তা পান। এ ছাড়াও রাজ্য পুলিশ সবসময় তাঁকে ঘিরে থাকে। তিনি যে পথ দিয়ে যান, সেই পথের দু’ধারে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা থাকে। আবার প্রচারে গিয়েছেন বলে তৃণমূল নেতা ও কর্মীরাও তাঁর সঙ্গে থাকেন। আবার, সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরাও তাঁকে ঘিরে থাকেন। তা হলে ঘটনার সময় তাঁরা কেউই সেখানে ছিলেন না কেন? কেউ কিছু দেখতে পেলেন না কেন? এত নিরাপত্তার মধ্যেও কী করে ৪–৫ জন মমতার কাছাকাছি গিয়ে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্য পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট পাঠিয়েছে নবান্নে। সেখানে ৪–৫ জনের আক্রমণ করা নিয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। যদিও তারা পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য আরও কয়েকদিন সময় চেয়েছে।
এদিকে, এদিনই সংবাদ মাধ্যমের কাছে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী মুখ খুলেছেন। তাঁরা কেউই আক্রমণ হওয়ার তত্ত্বকে সমর্থন করেননি। বরং, ঘটনাটিকে তাঁরা নেহাতই দুর্ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। স্থানীয় চিত্তরঞ্জন দাস বলেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির একটি দরজা খোলা ছিল। সামনের সিটে হাত জোড় করে মুখ্যমন্ত্রী মানুষের অভিবাদন গ্রহণ করেছিলেন। সরু রাস্তার ধারে একটি পিলারে গাড়ির দরজায় ধাক্কা লেগে ফিরে এলে মুখ্যমন্ত্রীর পায়ে চোট লাগে। কেউ ধাক্কা মারেনি। ৪–৫ জন দূরের কথা, মমতার কাছাকাছি কেউই ছিলেন না।’ শুধু চিত্তরঞ্জনবাবু নন, স্থানীয়দের অনেকেই মুখ খুলেছেন। তাঁরা কেউই আক্রমণের তত্ত্বকে সমর্থন করেননি। এমনকী, স্থানীয়দের কেউ কেউ মুখ্যমন্ত্রীর যাওয়ার দৃশ্য মোবাইলে রেকর্ড করছিলেন। তাঁদের কয়েকজনের মোবাইল ভিডিও এদিন কিছু টিভি চ্যানেল সংগ্রহ করে প্রকাশ করে। সেখানেও আক্রমণ করার কোনও দৃশ্য দেখা যায়নি। তাই আহত হলেও মুখ্যমন্ত্রী আক্রান্ত হয়েছেন, এমন তত্ত্ব ধোপে টিকছে না বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
অন্যদিকে, মমতার ‘আক্রান্ত’ হওয়ার অভিযোগে অনড় থেকে এদিন তৃণমূল নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়। শুধু তাই নয়, তারা অতিসক্রিয়তার অভিযোগ তুলে কার্যত নির্বাচন কমিশনকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। এ–সব অভিযোগ লেখা একটি স্মারকলিপি এদিন কমিশনে গিয়ে জমা দিয়ে আসেন তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং রাজ্যসভায় দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, এ ভাবে নির্বাচন কমিশনকে চাপে রাখতে চাইছে তৃণমূল। তবে কমিশন যে তৃণমূলের চাপের কাছে নত হবে না, তা স্পষ্ট হয়ে যায় এদিন রাতেই। কমিশনের সচিব রাকেশ কুমার একটি চিঠি পাঠিয়েছেন তৃণমূল দফতরে। সেখানে কড়া ভাষায় লেখা হয়েছে, তৃণমূলের স্মারকলিপি ভারতীয় সংবিধানের ৩২৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের মৌলিক নীতির বিরুদ্ধেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহত হওয়ার ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। কালক্ষেপ না করে বিষয়টি নিয়ে এখনই তদন্ত হওয়া উচিত।
শুধু তাই নয়, কমিশনের তরফে চিঠিতে আরও লেখা হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তায় ত্রুটি থাকা নিয়ে কমিশনের ওপর দায় চাপানো উচিত নয়। কারণ, মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাজ্যের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থারই। সেই সঙ্গে এ কথাও পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে, এই ধরনের স্মারকলিপির জবাব দেওয়াও কমিশনের কাছে মর্যাদাহানিকর। এ ছাড়া, এদিন রাজ্যের মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চিঠি পাঠিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আহত হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তলব করেছে নির্বাচন কমিশন। শুক্রবার বিকেল পাঁচটার মধ্যে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিকের দফতরে সেই রিপোর্ট জমা দিতে বলেছেন কমিশনের তরফে পুলিশ পর্যবেক্ষক বিবেক দুবে।
অন্যদিকে, এদিন মমতা জানিয়েছেন, কয়েকদিনের মধ্যে তিনি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন। তার পর ফের প্রচারে বের হবেন। তবে এবার তিনি ‘হুইলচেয়ারে’ করে প্রচারে যাবেন। বিষয়টি নিয়েও বিরোধী দলগুলি মন্তব্য করতে শুরু করেছে। অনেক দল বলছে, সহানুভূতি কুড়োতেই মুখ্যমন্ত্রী এ ভাবে প্রচারে যেতে চাইছেন। কোনও কোনও দল বলছে, ফের নাটক করতে চাইছেন তিনি।